আজ থেকে আরেক দফা বাড়ছে পাইকারি ও খুচরা পর্যায়ে বিদ্যুতের দাম। খুচরা গ্রাহক পর্যায়ে বিদ্যুতের দাম বাড়ছে ২৫ থেকে ৩০ শতাংশ। বর্তমান সরকারের মেয়াদে এই নিয়ে ষষ্ঠ বারের মতো দাম বাড়ানো হচ্ছে। তেলভিত্তিক বিদ্যুৎ উৎপাদন বেড়ে যাওয়ায় মূল্য সমন্বয় করতে বিদ্যুতের দাম বাড়ানো হচ্ছে বলে জানিয়েছে বাংলাদেশ অ্যানার্জি রেগুলেটরি কমিশন-বিইআরসি। তবে বিদ্যুতের দাম আরেক দফায় বাড়ানো হলেও লোডশেডিং পিছু ছাড়ছে না সহজেই। বরং দেশজুড়ে আরো ভয়াবহ লোডশেডিংয়ের আশঙ্কা রয়েছে। ইতোমধ্যেই তার নমুনা দেখা দিয়েছে। রোজা শেষ না হতেই দেশের অধিকাংশ স্থানে ঘণ্টায় ঘণ্টায় লোডশেডিং শুরু হয়েছে। বিদ্যুৎ উন্নয়ন বোর্ড (পিডিবি) সূত্র জানিয়েছে, রমজান মাসের তুলনায় এ মাসে প্রায় ১ হাজার মেগাওয়াট বিদ্যুৎ কম উৎপাদন হবে। কারণ বিদ্যুৎ উৎপাদনের জন্য রমজান মাসে যে ভর্তুকি দেয়া হয়েছিল তা এ মাসে তুলে নেয়া হয়েছে। আবার শিল্প-কারখানায়ও গ্যাসের চাহিদা বেড়েছে। এ অবস্থায় ব্যয় ও জ্বালানি সমন্বয় করতে বেশ কিছু বিদ্যুৎ কেন্দ্র বন্ধ রেখেছে পিডিবি। বাধ্য হয়ে লোডশেডিং দিচ্ছে বিতরণ কোম্পানিগুলো। পিডিবির হিসাব অনুযায়ী, রমজান মাসে তাদের গড় উৎপাদন ছিল ছয় হাজার মেগাওয়াটের বেশি। তখন বিদ্যুৎ কেন্দ্রে গ্যাসের সরবরাহ বাড়ানোর পাশাপাশি জ্বালানি তেলে অতিরিক্ত ভর্তুকি দেয়া হয়েছিল, কিন্তু ঈদের পর উৎপাদন কমিয়ে পাঁচ হাজারে নিয়ে আসা হয়েছে। অথচ চাহিদা রয়েছে সাড়ে ছয় হাজার মেগাওয়াটের বেশি। বিদ্যুতের এই অবস্থার মধ্যেই এ মাসের (সেপ্টেম্বর) বিদ্যুৎ বিলের সঙ্গে যোগ করা হচ্ছে অতিরিক্ত প্রায় ৩০ শতাংশ মূল্য। তবে এখনি নতুন মূল্য ঘোষণা করা হচ্ছে না। ঘোষণা করতে আরো কয়েকটা দিন সময় প্রয়োজন বলে জানিয়েছে বাংলাদেশ এনার্জি রেগুলেটরি কমিশন (বিইআরসি)।
একই সঙ্গে বিদ্যুতের ধাপ পদ্ধতিতে পরিবর্তন আনা হচ্ছে। বর্তমানে ৩টি ধাপ থাকলেও তা বাড়িয়ে ৭টি করা হচ্ছে বলে জানায় সংশ্লিষ্ট সূত্রগুলো। প্রসঙ্গত, বর্তমানে প্রতি ইউনিট বিদ্যুতের পাইকারি মূল্য গড়ে ৪ টাকা ২ পয়সা। আর খুচরা ৫ টাকা ৩২ পয়সা। গত মার্চ মাসে এই দর ষভসকার্যকর করা হয়। এরপর ছয় মাস না যেতেই আবারো বিদ্যুতের দাম বাড়ানোর ঘোষণায় ক্ষুব্ধ প্রতিক্রিয়া ব্যক্ত করেছেন সাধারণ গ্রাহকরা। তারা বলছেন, বিদ্যুতের দাম দফায় দফায় বাড়লেও উৎপাদন ও সরবরাহ বাড়ছে না। বরং দামের সঙ্গে পাল্লা দিয়ে বাড়ছে লোডশেডিং। রাজধানীর মাতুয়াইল এলাকার বাসিন্দা রানা মুহাম্মদ মাসুদ জানান, ঈদের পর থেকে তাদের এলাকায় দিন-রাত মিলিয়ে ১০ ঘণ্টাও বিদ্যুৎ থাকছে না। এক ঘণ্টা বিদ্যুৎ থাকলে পরবর্তী দেড় ঘণ্টা লোডশেডিং দেয়া হচ্ছে। গভীর রাতেও বিদ্যুৎ থাকে না। এ কারণে পানি নিয়েও সমস্যা দেখা দিয়েছে। গরমে ঘুমানো যায় না। সবমিলিয়ে বিদ্যুৎ নিয়ে ভয়াবহ দুর্ভোগ পোহাচ্ছেন তারা। দাম বাড়ানো প্রসঙ্গে বিইআরসির চেয়ারম্যান সৈয়দ ইউসুফ হোসেন বলেন, বিদ্যুৎ খাতে সরকারের ভর্তুকি এবং গ্রাহকদের ভোগান্তি সব বিষয়ই আমাদের দেখতে হয়। তারপরেও বাস্তবতার আলোকে দাম বাড়াতে হচ্ছে। তবে দাম বাড়ানোর ক্ষেত্রে নিম্ন আয়ের মানুষের বিষয়টি বিশেষ বিবেচনায় নিয়ে কাজ করছি। বিইআরসির সদস্য সেলিম মাহমুদ জানিয়েছেন, বিদ্যুতের বর্ধিত মূল্য চূড়ান্ত হলেও তা আজ রোববার আনুষ্ঠানিকভাবে ঘোষণা করা হচ্ছে না। তা ঘোষণা করতে আরো ৭/৮দিন সময় লাগতে পারে। তবে বর্ধিত এ মূল্য সেপ্টেম্বরের এক তারিখ থেকে কার্যকর হবে। এবার বিদ্যুতের মূল্য পুনর্নির্র্ধারণের পর আগামী এক বছরের মধ্যে নতুন করে আর দাম বাড়নো হবে না বলেও জানান বিইআরসির সদস্য সেলিম মাহমুদ। প্রসঙ্গত, বিদ্যুতের দাম বাড়ানোর এই প্রস্তাবটি করা হয় গত জুন মাসে। তখন পিডিবি বিদ্যুতের পাইকারি দাম আরো ৫০ শতাংশ এবং বিতরণকারী সংস্থাগুলো গ্রাহক পর্যায়ে ৫৬ শতাংশ পর্যন্ত দাম বৃদ্ধির প্রস্তাব করে। প্রস্তাবের ওপর গত ১৬ জুলাই গণশুনানি অনুষ্ঠিত হয়। শুনানি শুরুর আগেই বিইআরসির মূল্যায়ন কমিটি বিদ্যুতের দাম ২২ শতাংশ বাড়ানোর সুপারিশ করে। এদিকে বারবার বিদ্যুতের দাম বাড়ানো হলেও তা পিডিবির ভর্তুকি কমাতে কার্যকর কোনো প্রভাব ফেলতে পারছে না বলে মনে করেন জ্বালানি বিশেষজ্ঞরা। তাদের মতে, দাম বাড়িয়ে যে অর্থ পাওয়া যায় তা আবার বেসরকারি কেন্দ্র থেকে উচ্চমূল্যে বিদ্যুৎ সরবরাহ করতেই শেষ হয়ে যাচ্ছে। আর এ কারণে পিডিবি বরাবরই দুদর্শাগ্রস্ত থেকে যাচ্ছে। এ জন্য বিদ্যুৎ নিয়ে সরকারের পরিকল্পনাকে দায়ী করেছেন কেউ কেউ। এ বিষয়ে বাংলাদেশ ইন্সটিটিউট অব ডেভেলপমেন্ট স্ট্যাডিজের (বিআইডিএস) প্রধান গবেষক ও অর্থনীতিবিদ জায়েদ বখত বলেন, কুইক রেন্টাল দিয়ে উৎপাদন বাড়াতে গিয়ে সরকার খরচ বাড়িয়েছে। তাই দফায় দফায় বিদ্যুতের দাম বাড়ছে। এছাড়া ভর্তুকি কমাতে দাতাগোষ্ঠীর চাপ থেকেও বিদ্যুৎ ও জ্বালানির দাম বাড়ছে। ব্যয় বাড়িয়ে উৎপাদন এবং দাম বাড়ানোর সাথে সেবার মান জড়িত। সরকার উৎপাদন বেড়েছে এমন দাবি করছে_ এটি সত্যি হলেও তা ভবিষ্যতে কাজে আসবে না। তার মতে, অতিরিক্ত ব্যয় বরং দীর্ঘমেয়াদে অর্থনীতিতে চাপ ফেলবে। তিনি বলেন, কুইক রেন্টাল দিয়ে সরকারকে বিদ্যুৎ উৎপাদনে নির্ভরশীলতা পরিত্যাগ করতে হবে। নির্ভরশীলতার জন্য টেকসই পরিকল্পনা বাস্তবায়ন করতে হবে। সূত্র মতে, গত তিন বছরে পিডিবির নিজস্ব বিদ্যুৎ কেন্দ্রের উৎপাদন আশঙ্কাজনক হারে কমেছে। চাহিদা অনুপাতে উৎপাদন না বাড়িয়ে এ সময়ের মধ্যে বিপুল পরিমাণ গ্রাহককে বিদ্যুৎ সংযোগ দেয়া হয়েছে। সবশেষ কারণটি হলো_ নতুন যেসব ভাড়াভিত্তিক কেন্দ্র উৎপাদনে এসেছে সেগুলো থেকেও আশঙ্কাজনক হারে উৎপাদন কমে গেছে। বিশেষজ্ঞরা জানান, গত সাড়ে তিন বছর বিদ্যুৎ বিভাগ যে পরিকল্পনা করে এগিয়েছে, তাতে কেবল সরকারের ভর্তুকি বেড়েছে। স্থায়ী কোনো সমাধান আসেনি। স্থায়ী সমাধান না করে সরকার কেবল দৈনন্দিন চাহিদা পূরণে ব্যস্ত ছিল। এ জন্য তারা ভর্তুকির দিকে নজর না দিয়ে রেন্টাল ও কুইক রেন্টাল বিদ্যুৎ কেন্দ্র থেকে উচ্চমূল্যে বিদ্যুৎ সরবরাহ করে গেছে। যা এখনো অব্যাহত আছে। যেখানে উৎপাদন খরচ অনেক বেশি। জ্বালানি বিশেষজ্ঞ ও পাওয়ার সেলের সাবেক মহাপরিচালক বিডি রহমতউল্লাহ বলেন, সরকারের উচিত ছিল শুরু থেকেই ভর্তুকির বিষয়টি বিবেচনায় নিয়ে স্থায়ী বিদ্যুৎ কেন্দ্র স্থাপনে পদক্ষেপ নেয়া। কিন্তু অর্থ লুটপাটের উদ্দেশ্যে সরকারের কর্তাব্যক্তিরা সে পদক্ষেপ নেয়নি। রাজু জমা: ৬.৪০