ভাষা আন্দোলনে মেহেরপুর
লেখক :জি এফ মামুন লাকী
পূর্ব কথা :
আমরা বাঙালী ও বাংলাদেশী। বাংলা শুধু আমাদের মাতৃভাষা নয়, রাষ্ট্র ভাষাও। অনেক চড়াই উৎরাই পেরিয়ে ১৯৪৭ সালে দ্বি-জাতিতত্ত্বের ভিত্তিতে পাকিস্থান ও ভারত নামে দুটি স্বাধীন রাষ্ট্রের জন্ম হয়। সে সময় এদেশের সাধারণ মানুষের মনে একটি বিশ্বাস জন্ম নিয়েছিল যে, তারা ব্রিটিশদের কাছ থেকে যে সকল ন্যায্য অধিকার থেকে বঞ্চিত হয়েছিল, পাকিস্থান রাষ্ট্র হলে সে সব বঞ্চনা ও সমস্যার সমাধান হবে। তখন পাকিস্থানের উভয় অংশের জনগণ ভোগ করবে সমঅধিকার। কিন্তু পাকিস্থান প্রতিষ্ঠার পর পূর্ব পাকিস্থানের সাধারণ মানুষ চরম ভাবে অবহেলিত হতে লাগল। তাদের মাঝে জমা হতে থাকে ক্ষোভ। পূর্ব পাকিস্থানের মানুষ দেখতে পায় রাষ্ট্রীয় ক্ষেত্রে এদেশের মানুষের কোন মূল্যায়ণ নেই, অথচ ভাষাভাষীর দিক থেকে উর্দ্দু ভাষী মানুষ ছিল শতকরা ৮ ভাগ। আর বাংলা ভাষী মানুষ ছিল ৫৬ ভাগ।
১৯৪৮ সালের ২৩ ফেব্র“য়ারী পাকিস্থান গণপরিষদের অধিবেশন শুরু হয়। অধিবেশনে পূর্ব পাকিস্থান কংগ্রেস (পূর্ব বাংলা) দলের সদস্য ধীরেন্দ্র নাথ দত্ত একটি সংশোধনী প্রস্তাব উত্থাপন করেন। সংশোধনটি ছিল খসড়া নিয়ন্ত্রণ প্রণালীর ২৯নং ধারা সম্পর্কে। এই ধারায় বলা হয়েছিল পরিষদের সকল সদস্যকে ইংরেজি বা উর্দ্দু ভাষায় বক্তৃতা করতে হবে। ধীরেন্দ্রনাথ দত্ত ইংরেজী ও উর্দ্দুর পাশাপাশি বাংলাকেও গণপরিষদের সরকারী ভাষা করার প্রস্থাব করেন। ২৫ ফেব্রুয়ারী এই প্র¯তাব সম্পর্কে অধিবেশনে আলোচনা হয় এবং তুমুল বিতর্কের পরও তা অগ্রাহ্য হয়।
১৯৫২ সালে ২৭ জানুয়ারী পাকিস্থানের প্রধানমন্ত্রী খাজা নাজিমউদ্দিন ঢাকা সফরে আসেন এবং নিখিল পাকি¯হান মুসলিম লীগের পল্টন ময়দানে অনুষ্ঠিত এক জনসভায় ভাষন দেন। বক্তৃতায় তিনি উর্দ্দূকে পাকি¯হানের একমাত্র রাষ্ট্রভাষা হিসেবে ঘোষনা করেন। এ ঘোষনার প্রতিবাদে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে রাষ্ট্রভাষা সংগ্রাম পরিষদ ৩০ জানুয়ারী ছাত্র ধর্মঘট ও সভা আহবান করে। ২৭ জানুয়ারী থেকে ২১ ফেব্রুয়ারী পর্যন্ত যে কর্মসূচী গৃহিত হয় তাতে দুটি দাবী ছিল এক. বাংলাকে রাষ্ট্রভাষা করা দুই. আরবী হরফে বাংলা লেখার প্রচলন বন্ধ করা।
ভাষা আন্দোলন : ১৯৫২ সালের ৩১ জানুয়ারী ২১ ফেব্রুয়ারীকে রাষ্ট্রভাষা দিবস হিসেবে পালন করার প্রস্ততি গ্রহণ করে সর্বদলীয় রাষ্ট্রভাষা সংগ্রাম পরিষদ এবং ঐ দিন তদানীন্তন প্রদেশের সর্বত্র সাধারণ ধর্মঘট এবং শোভাযাত্রা সহকারে ২১ ফেব্রুয়ারী রাষ্ট্রভাষা দিবস হিসেবে পালন করা হবে ঠিক হয়। ২১ ফেব্রুয়ারীর আগের সভা ও মিছিলগুলির কারণে কেবল ছাত্রদের মধ্যেই নয়, সাধারণ মানুষের মধ্যেও সচেতনতা জাগ্রত হয়েছিল এবং সকলে প্রতিরোধ ও সংগ্রামের প্রত্যক্ষ কর্মসূচীই প্রত্যাশা করছিল। এরকম অবস্থায় পূর্ব পাকিস্থান (পূর্ব বাংলা) সরকার ২০ ফেব্রুয়ারী থেকে ১ মাসের জন্য ১৪৪ ধারা জারি করে ঢাকা শহরে যে কোন রকম সভা সমাবেশ, শোভাযাত্রা ও মিছিল প্রভৃতি সম্পূর্ণরুপে নিষিদ্ধ ঘোষণা করে।
১৯৫২ সালের ২১ ফেব্রুয়ারী দিনটি ছিল বৃহস্পতিবার ৮ ফাল্গুন ১৩৫৮ বঙ্গাব্দ ২৪শে জমাদিউল আওয়াল ১৩৭১ হিজরী। ছাত্ররা ১৪৪ ধারা ভংগ করার জন্য যাবতীয় প্রস্তুতি শেষ করে রেখেছিল। সিদ্ধান্ত মত ছাত্ররা ২/৪ জন করে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় ও ঢাকা মেডিকেল কলেজ এলাকায় জমায়েত হচ্ছে। বৈকাল ৩ ঘটিকায় ছাত্ররা ১৪৪ ধারা অমান্য করে মিছিল বের করে। এ সময় ছাত্রদের একটি অংশ কর্তব্যরত পুলিশ ও ইপিআর এর সাথে সংঘর্ষে জড়িয়ে পড়ে। প্রচন্ড সংঘর্ষে ছাত্রদের নিক্ষিপ্ত ইটের সামনে পুলিশ পিছু হটতে বাধ্য হয়। ছাত্ররা পুলিশ ও ইপিআর ক চারদিক থেকে ঘেরাও করে বিক্ষোভ করতে থাকলে এক পর্যায়ে পুলিশ গুলিবর্ষণ করে। পুলিশের গুলিতে প্রথম নিহত হয় একজন রিকসা চালক, তার পর সালাউদ্দিন, বরকত, রফিক, জব্বার। পুলিশের গুলি বর্ষনে ছাত্র জনতা নিহত হওয়ায় সাধারণ মানুষের কান্না জড়িত ক্ষুব্ধ মুখ দেখা যায়। এরই প্রতিফলন ঘটেছিল ২২ ফেব্রুয়ারী অর্থাৎ পর দিন শুক্রবার ঢাকা মেডিকেল কলেজ ব্যারাকে নিহতদের জানাযার নামাজে হাজার হাজার মানুষের অংশ গ্রহণ। সকলে চোখে মুখে ঘৃণা ও ক্রোধ নিয়ে সমবেত হয়। ২২ ফেব্রুয়ারী জানাযার নামাজ শেষে ছাত্র জনতা শহীদদের লাশ নিয়ে মিছিল বের করলে পুলিশ আবারো মিছিলে গুলি চালায়। পুলিশের গুলিতে অহিউল্লাহ নামের ১৪ বছরের এক কিশোরসহ নিহত হয় ৪ জন। এঘটনার পর রাষ্ট্র ভাষার দাবী ছড়িয়ে পড়ে মফস্বলএলাকা গুলোতে।
১৯৪৭ সাল থেকে মেহেরপুরের রাজনৈতিক অঙ্গন ছিল মুসলিম লীগের দখলে। ১৯৫২ সালের ভাষা আন্দোলনের ইতিহাসে মেহেরপুরের কোন রাজনীতিক, রাজনৈতিক দল বা ছাত্র সংগঠন কোনরুপ ভূমিকা পালন করেছিল কি না তার কোন সঠিক ইতিহাস পাওয়া যায় না। তবে সাংবাদিক সৈয়দ আমিনুল ইসলাম রচিত মেহেরপুরের ইতিহাস থেকে জানা যায়, ১৯৫২ সালের কয়েক দিন পর অর্থাৎ ২৪ ফেব্রুয়ারী মেহেরপুর মডেল ইংরেজি হাই স্কুলের ছাত্র মুন্সি সাখাওয়াৎ হোসেন (কবি নজরুল শিক্ষা মঞ্জিলের প্রাক্তণ প্রধান শিক্ষক) কাওছার আলী (চানা) ওরফে গোলাম কাওছার (চানা) (মেহেরপুর পৌর সভার অবসর প্রাপ্ত কর্মচারী) বংকু ঘোষ ওরফে সতীনাথ ঘোষ (বড় বাজার বাগান পাড়া) শান্তি নারায়ন চক্রবর্তী (কাশ্যবপাড়া) প্রমুখ ছাত্র নেতা মেহেরপুর শহরের গুরুত্বপূর্ণ স্থানে রাষ্ট্রভাষা বাংলার দাবীতে পোস্টারিং, পিকেটিংসহ মিছিল বের করেছিল। এর পর ১৯৫৪ সালে ২১ ফেব্রুয়ারী মাতৃভাষা দিবস ২২ ফেব্রুয়ারী পালনে মেহেরপুর শহরে মিছিল ও পোস্টারিং করে মেহেরপুর মডেল ইংরেজী হাইস্কুলের ছাত্ররা। বিদ্যালয়ের শৃংখলা ভংগের অপরাধে উক্ত বিদ্যালয়ের ছাত্র নজীর হোসেন (পিরোজপুর) ইসমাইল হোসেন (জেলা আওয়ামী লীগের সহসভাপতি) মরহুম কবির খান (মাধ্যমিক বালিকা বিদ্যালয়ের সামনে) মনিরুল ইসলাম (ডাঃ আবু জাফর এর পুত্র বাসষ্ট্যান্ড, মেহেরপুর) মরহুম সামসুল আলা (বড় বাজার, মেহেরপুর) প্রমুখ কে বিদ্যালয় থেকে রাজটিকিট করা হয়। পরবর্তীতে তা পরিবর্তন করে বিদ্যালয় থেকে বহিস্কার করে। এ সময় বিদ্যালয়ের প্রধান শিক্ষক ছিলেন শিক্ষাবিদ ও মুসলিম লীগ মহকুমা ও জেলা সভাপতি জনাব সাবদার আলী।
এছাড়া ১৯৫৪ সালের ২২ ফেব্রুয়ারী মেহেরপুরের গাংনীতে রাষ্ট্রভাষা দিবস পালিত হয়। মোঃ দাউদ হোসেন (চেংগাড়া) মোঃ সিদ্দিক হোসেন (চৌগাছা) ইসলাম আলী মাস্টার (যাদবপুর) খোরশেদ আলী (গাংনী) প্রমুখ ছাত্র নেতা গাংনী শহরে রাষ্ট্রভাষা বাংলার দাবীতে মিছিল করেছিল বলে জানা যায়।
ঐক্যবদ্ধ বাঙালীর আন্দোলনের তীব্রতায় তদানিন্তন পাকি¯থান সরকার বাংলাকে অন্যতম রাষ্ট্রভাষা করার পক্ষে প্রস্থাব গ্রহণ করতে বাধ্য হয়। ১৯৫৩ সালে মূলনীতি কমিটির রিপোর্টেও বাংলাকে পাকি¯থানের অন্যতম সরকারী ভাষা হিসেবে মর্যাদা প্রদানের সুপারিশ করা হয়। ১৯৫৬ সালে সংবিধানে উর্দ্দূর সংগে বাংলাও রাষ্ট্রভাষা হিসেবে আনুষ্ঠানিক ভাবে স্বীকৃতি লাভ করে।
২১ এর চেতনায় বাঙালীরা ৫৪’র নির্বাচন ৫৮’র সামরিক শাসন বিরোধী আন্দোলন ৬৬’ ছয় দফা কর্মসূচী, ৬৯’র ১১ দফা ও গণআন্দোলন ’৭০ এর নির্বাচন সর্বপরি ১৯৭১ সালে মুক্তি সংগ্রামে ২১ ফেব্রুয়ারী বাঙালী জাতিকে করে অনুপ্রাণীত। ১৯৫২ সালে কতজন ছাত্র-জনতা পুলিশের গুলিতে শহীদ হয়েছে তার নির্দিষ্ট কোন সংখ্যা এখনো অজানা রয়ে গেছে। ভাষা আন্দোলনের সঠিক ইতিহাস না জানার কারনে প্রশাসন সহ স্বেচ্চাসেবক অনেক সংগঠন ৫২ সালের ভাষা আন্দোলনে অবদানকারী প্রকৃত ভাষা সৈনিকদের মূল্যায়ন না করে তাদের পাশ কাটিয়ে ১৯৫৪ সালে ভাষা দিবস পালনকারীদের ভাষা সৈনিক এর মর্যাদায় প্রতিষ্ঠিত করে বিভিন্ন সম্মানে ভূষিত করে ভাষা আন্দোলনের ইতিহাসকে বিকৃত করার চেষ্টায় লিপ্ত রয়েছে। পৃথিবীর বুকে একমাত্র বাঙালী জাতিই রক্তাক্ত সংগ্রামের মাধ্যমে ছিনিয়ে এনেছে তার ভাষার অধিকার।
ইউনেস্কো ১৯৯৯ সালে ১৭ নভেম্বর ৩০ তম অধিবেশনে ২১ ফেব্রুয়ারীকে আন্তর্জাতিক মাতৃভাষা দিবস ঘোষণা করে। বিশ্বের ১৮৮টি দেশে ২১ ফেব্রয়ারী আন্তর্জাতিক মাতৃভাষা দিবস হিসেবে পালিত হচ্ছে। এই দিনটি পালন করতে গিয়ে সারা বিশ্বের মানুষের মুখে বার বার উচ্চারিত হচ্ছে সেই সব শহীদ ও তাদের সহকর্মীদের নাম।
২১ এর চেতনায় বলিয়ান আমরা বাঙালী আজ শপথ নিই ভাষার জন্য যেন কোন মিথ্যাকে প্রশ্রয় না দিই।
তাই শেষ শ্রদ্ধা জানাই তাদের যারা কবির ভাষায় প্রমাণ করেছে “মৃত্যুর চেয়ে জীবন অনেক বড়” একথা সবাই জানে। কিন্তু কখনো মৃত্যু বড় হয় জীবনের শেষ দানে”।
লেখক-
সাংবাদিক ও সমাজ সেবক
মোবাইল নং: ০১৭১৭৮১৩৬০৬