কবি বেগম সুফিয়া কামালের কিছু কথা

বেগম সুফিয়া কামাল স্মরণে
শ্রদ্ধাঞ্জলি
জীবনের সূচনায় বেগম সুফিয়া কামাল ছিলেন কবি; রোমান্টিক ঘরানার, মানে সুন্দরের, প্রেমের, বিরহের, কল্পনার, আবেগের গীতিকবি। আর বাস্তব জীবনে তিনি মহীয়সী নারী
বেগম সুফিয়া কামালের জন্ম ২০ জুন ১৯১১ । বাবা আবদুল বারী সায়স্তাবাদের জমিদার। মা সাবেরা বেগম নওয়াব মীর মোয়াজ্জেম হোসেনের কন্যা।
মাত্র ১১ বছর বয়সে তাঁর বিয়ে হয় শরিফ পরিবারের রীতি মাফিক। যৌবনে, যখন তাঁর বয়স মাত্র বাইশ, তিনি স্বামী সৈয়দ নেহাল হোসেনকে হারান। তাঁর অনেক কবিতার ছত্রে ছত্রে সেই বেদনার সঙ্গীত শোনা যায়। পরে কামাল উদ্দীন আহমেদের সঙ্গে তাঁর বিবাহিত জীবনও সুখের হয়েছিল। তাঁদের পাঁচ সন্তানের মধ্যে চার জন বেঁচে আছেন, আদর্শিক আত্মজা সুলতানা কামাল অন্যতম।
১৯১৮ খ্রিস্টাব্দে যখন সুফিয়া কামালের বয়স মাত্র সাত, কলকাতায় মায়ের সঙ্গে তিনি যান বেগম রোকেয়ার সঙ্গে সাক্ষাৎ করতে। ১৪ বছর বয়সে মহাত্মা গান্ধীর সঙ্গে তিনি সাক্ষাৎ করেন। সরল জীবনাচরণ ও অহিংসার যে প্রেরণা তিনি তখন পেয়ে গেলেন, সেটা কখনও তিনি ভুলতে পারেন নি।
তাঁর মধ্যে প্রথম প্রবল সক্রিয়তা লক্ষ করা যায় ১৯৪৭-৪৮ দেশ বিভাজনের সময় , যখন ভীষণ সাম্প্রদায়িক সংঘাত শুরু হয়। তিনি শান্তি ও সম্প্রীতির জন্য কাজ করেন এবং ১৯৪৮-এ পূর্বপাকিস্তান মহিলা কমিটি গঠন করেন আর এর সভাপতির দায়িত্বও গ্রহণ করেন । ১৯৫২-র ভাষা আন্দোলনে তিনি অংশ নেন এবং ১৯৬১-র রবীন্দ্রসংগীত নিষিদ্ধ করণের প্রতিবাদে যারা প্রবল আন্দোলন গড়ে তুলেছিলেন তিনি তাঁদের অন্যতম। ১৯৬৯ এর আইয়ুব বিরোধী গণুভ্যুত্থানে তাঁর সংগঠিত মহিলা সংগ্রাম পরিষদ অগ্রণী ভূমিকা পালণ করে।
১৯৭১-এ শহিদুল্লাহ কায়সায়ের সঙ্গে তিনি যে মুক্তিযোদ্ধা দলকে সহযোগিতা করেন, আলভি ছাড়া তাঁদের প্রায় সকলেই পাক বাহিনীর হাতে মারা যায়।
তাঁর সংগ্রামী জীবনের কথা সংক্ষেপে বলে শেষ করা যায় না । যদিও এটা না বললেই নয় যে তিনি অমর হয়ে থাকবেন বাংলাদেশের মানুষের মনে মুক্তিযুদ্ধের চেতনা সঞ্জীবিত করার ক্ষেত্রে তাঁর অসামান্য অবদানের জন্য। অবশ্য তাঁর কবিতার অনুরাগী পাঠকের সংখ্যাও কিন্তু কম নয়। আমি অবশ্য ব্রাক প্রতিষ্ঠায় তাঁর অবদানকে তেমন গুরুত্ব দিই না।
উদারতা এবং মহানুভবতা বোধ হয় তাঁর জন্মগত। বাবা এতটাই নৈষ্ঠিক সুফি ছিলেন যে দরবেশী বৈরাগ্যে আক্রান্ত হয়ে তিনি গৃহত্যাগ করেন; আর ফিরে আসেন নি। সেখান থেকেই তিনি মরমী সাধকদের বিবেকের ধর্ম উত্তরাধিকার হিসেবে পান।
পরিশেষে আবার তাঁর কবিতার প্রসঙ্গ। রবীন্দ্রভাবাদর্শের হলেও অত্যন্ত জীবনঘন কবিতা ‘বাসন্তী’ প্রকাশিত হয় ‘সওগাত’ পত্রিকায়, ১৯২৬-এ; ১৯৩৭-এ প্রকাশিত হয় গল্পগ্রন্থ ‘কেয়ার কাঁটা’; ১৯৩৮ –এ সুবিখ্যাত সাঁঝের মায়া কাব্যটি প্রকাশিত হয় এবং রবীন্দ্রনাথের প্রশংসা অর্জন করেন। পরবর্তী অবশিষ্ট জীবন ছিল জটিল কর্মময় এবং আদর্শিক, এসময়ে তিনি মূলত সাংবাদিকতা, সংগ্রাম ও সৃজনশীলতার সঙ্গে যুক্ত ছিলেন।
১৯৯৯ এর ২০ নভেম্বর তাঁর দেহাবসান হয়। রাষ্ট্রীয় মর্যাদায় তাঁর অন্ত্যেষ্টি হয়।
আমি অবশ্য তাঁকে নারীবাদী মনে করি না, নারীঅধিকারবাদী বলে মনে করি। এবং আমি মনে করি, তাঁর প্রতিষ্ঠিত বাংলাদেশ মহিলাপরিষদ তাঁর আদর্শ অনুসরণের চেষ্টা করে থাকে।
আমি তাঁর ও তাঁর সংগঠনের সঙ্গে যে বিষয়ে সম্পূর্ণ একমত তা হলো, নারীর লিঙ্গীয় বা স্বকীয়, ব্যক্তিগত, পারিবারিক এবং সামাজিক সমস্যা সমন্বয়ী বা সমঝোতার চেতনা দিয়ে সমাধান করা উচিৎ, এক্ষেত্রে আপসহীন স্বাতন্ত্র্যচেতনা সমস্যাকে জটিল করে। কারণ নারীর মুক্তি তার জাতীয় মুক্তির সঙ্গে সম্পর্কিত। পুরুষ থেকে স্বতন্ত্র এবং বিচ্ছিন্ন কোনও জৈবরাজনীতি নারীর থাকতে পারে না। নারী তো পূর্ণাঙ্গ মানুষ ছাড়া কিছু না।
চেতনায় বেগম সুফিয়া কামাল চিরঞ্জীব।
প্রফেসর স্বপন কুমার রায়
‌অধ্যক্ষ (অবঃ)
মুজিবনগর সরকারি ডিগ্রী কলেজ।

অন্যান্য নির্বাচিত বাংলাদেশ