হত্যাকাণ্ড ডাকতে পুলিশের ক্রসফায়ার

নিউজ ডেস্ক:
রাজধানীর পল্লবী এলাকা। গত আগস্টে হঠাৎ ওই এলাকার আইন-শৃঙ্খলা পরিস্থিতির অবনতি হতে থাকে। এমন পরিস্থিতিতে ৫ আগস্ট ঘটে আরেকটি চাঞ্চল্যকর খুন। পল্লবীর নতুন রাস্তার সাগুফতা হাউজিং এলাকার একটি টংঘর থেকে মোহাম্মদ আলী নামে এক যুবকের গুলিবিদ্ধ লাশ উদ্ধার করে পুলিশ। ওই ঘটনার পর পল্লবী থানার ওসি আবদুল লতিফ ও এসআই এনামুল হক (আলীর ঘটনায় দায়ের করা মামলার প্রথম তদন্ত কর্মকর্তা) গণমাধ্যমকর্মীদের বলেছিলেন, নিহত মোহাম্মদ আলী থানার তালিকাভুক্ত সন্ত্রাসী। কোনো আইন প্রয়োগকারী সংস্থার সঙ্গে ক্রসফায়ারে নিহত হতে পারে সে। র‌্যাব আছে, সিআইডি আছে। তারাও আসামি ধরে। তবে ঘটনার ২৫ দিন পর ঢাকা মহানগর গোয়েন্দা পুলিশের (ডিবি) তদন্তে বেরিয়ে এসেছে চাঞ্চল্যকর তথ্য। গোয়েন্দাদের তথ্য অনুযায়ী, মোহাম্মদ
আলী ক্রসফায়ারে নিহত হয়নি। প্রতিপক্ষ সন্ত্রাসী গ্রুপ তাকে গুলি করে হত্যা করেছে। এ হত্যাকাণ্ডে জড়িত বেশ ক’জনকে এরই মধ্যে গোয়েন্দা নজরদারিতে রাখা হয়েছে। হত্যায় জড়িতদের মধ্যে দু’জনকে শনাক্তও করা হয়েছে।
গোয়েন্দা সূত্র জানায়, মোহাম্মদ আলী হত্যার সঙ্গে সন্ত্রাসী মূসা বাহিনীর লোকজন জড়িত। সম্প্রতি মূসার ক্যাডারদের সঙ্গে দুর্ব্যবহার করেন আলী। এ নিয়ে তাদের মধ্যে বিরোধ চলছিল। আলী হত্যার পেছনে মূসার বাহিনীর কয়েকজন ক্যাডার জড়িত বলে ধারণা করা হচ্ছে।
ডিবির তদন্তে হত্যার তথ্য বেরিয়ে আসার পর আলীর মৃত্যু নিয়ে থানা পুলিশের এমন দায়সারা বক্তব্যে প্রশ্ন উঠেছে। পুলিশের ‘ক্রসফায়ার’ গল্পের কারণ অনুসন্ধান করতে গিয়ে বেরিয়ে এসেছে আরেক চাঞ্চল্যকর তথ্য। মোহাম্মদ আলী হত্যাকাণ্ডের আগে পল্লবী এলাকায় পরপর একাধিক খুনের ঘটনা ঘটে। এ কারণে ‘চাপে’ ছিল থানা পুলিশ কর্তৃপক্ষ। তাই আলী হত্যার পরপরই আগ বাড়িয়ে পুলিশ মিডিয়াকর্মীদের কাছে মৃত্যুর কারণ ‘ক্রসফায়ার’ হতে পারে বলে দাবি করে। এমনকি থানা পুলিশের পক্ষ থেকে আইন-শৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর ঊর্ধ্বতন কর্তৃপক্ষের কাছেও বিষয়টিকে ‘ক্রসফায়ার’ হিসেবে উপস্থাপন করা হয়।
ঢাকা মহানগর গোয়েন্দা পুলিশের একজন ঊর্ধ্বতন কর্মকর্তা নাম প্রকাশ না করার শর্তে সমকালকে বলেন, মোহাম্মদ আলী হত্যার ঘটনাটি ক্রসফায়ার ছিল না। প্রতিপক্ষের হাতে সে খুন হয়েছে। এ ব্যাপারে আরও তদন্ত চলছে। ডিবি পরিদর্শক নিবারণ চন্দ্র বর্মণ সমকালকে বলেন, মোহাম্মদ আলী হত্যায় জড়িত আসামিদের গ্রেফতারে অভিযান চলছে।
মামলাটির বর্তমান তদন্ত সংস্থা ডিবি পুলিশের ঊর্ধ্বতন এক কর্মকর্তা সমকালকে বলেন, আগস্টে মিরপুর-পল্লবী এলাকায় একাধিক খুন ও গুলির ঘটনা ঘটে। এমনকি বাসার নিচে বোমা পুঁতে চাঁদা দাবির ঘটনাও ঘটে। এ কারণে চাপ এড়াতে আলীর গুলিবিদ্ধ লাশ উদ্ধারের পরপরই এ ঘটনাটিকে ঊর্ধ্বতন পুলিশ কর্মকর্তা মিডিয়াকর্মীদের কাছে ‘ক্রসফায়ার’ বলে দাবি করেছিলেন। যুবকের লাশ উদ্ধারের খবর পেয়ে ডিবি পুলিশের একটি দল ঘটনাস্থলে ছুটে গেলে থানা পুলিশের পক্ষ থেকে তখনও দাবি করা হয়, মোহাম্মদ আলী বন্দুকযুদ্ধে মারা যেতে পারে। তবে প্রথম থেকে থানা পুলিশের তদন্ত ছাড়াই এ ঘটনায় হওয়া মামলাটির দায়িত্ব নেয় ডিবি পুলিশ। বিষয়টি গুরুত্ব দিয়ে তদন্ত করে ডিবি জানতে পারে, মোহাম্মদ আলী ক্রসফায়ারে নয়, প্রতিপক্ষ সন্ত্রাসীদের গুলিতে নিহত হয়েছে।
পুলিশের পল্লবী জোনের সহকারী কমিশনার শাহ ইফতেখার আহমেদ সমকালকে বলেন, তদন্ত সম্পন্ন না হওয়ার আগেই কেন কী কারণে থানা পুলিশ কর্তৃপক্ষ আলীর হত্যাকাণ্ড ‘ক্রসফায়ার’ বলে মন্তব্য করেছে_ এটা আমার জানা নেই। যারা এ ব্যাপারে মন্তব্য করেছেন, তারাই বলতে পারবেন।
প্রতিপক্ষের গুলিতে মোহাম্মদ আলী খুন হয়েছেন_ অনুসন্ধান শেষে ডিবি পুলিশ এটা নিশ্চিত হলেও এখনও ক্রসফায়ার তত্ত্ব থেকে সরে আসেনি পল্লবী থানা পুলিশ। গতকাল শনিবারও পল্লবী থানার এসআই এনামুল হক সমকালকে বলেন, মোহাম্মদ আলীর মৃত্যু নিয়ে তদন্ত চলছে। ডিবি মামলাটির তদন্ত করছে। ক্রসফায়ারেই সে মারা যেতে পারে।
তবে নিহত মোহাম্মদ আলীর পরিবার প্রথম থেকেই গণমাধ্যমে বলে আসছিল, এসআই এনামুলের সঙ্গেও মোহাম্মদ আলীর দ্বন্দ্ব ছিল। এ হত্যাকাণ্ডে তার হাত থাকতে পারে। নানা আলোচনা-সমালোচনার পর অবশ্য এ মামলাটি এখন মহানগর গোয়েন্দা পুলিশ (ডিবি) তদন্ত করছে।
মোহাম্মদ আলীর মা শাহনাজ বেগম জানান, ঘটনার দিন তার ছোট ছেলে দুবাই যায়। তাকে বিদায় দিতে পরিবারের সদস্যরা বিমানবন্দরে যায়। ওইদিন দুপুর ২টায় পোস্তগোলার বাসার উদ্দেশে রওনা দিলেও মোহাম্মদ আলী তার বন্ধু সুমনের সঙ্গে মিরপুরের দিকে যায়। দেড় ঘণ্টা পর সুমন ফোনে জানায়, পুলিশের তথ্যদাতা টিটু ও তার সহযোগী কালাম, বাপ্পীসহ কয়েকজন মোহাম্মদ আলীকে ধরে নিয়ে গেছে। এর কিছুক্ষণ পর টিটু মোবাইল ফোনে লাশ পাওয়ার খবর দেয়।
এদিকে আলীর স্ত্রী নিপা আক্তার গতকাল সমকালকে বলেন, আলী হত্যার পরপরই পুলিশ ক্রসফায়ারের কথা বলেছিল। পল্লবী থানা পুলিশ দাবি করে_ আলীর বিরুদ্ধে এক ডজনের বেশি মামলা রয়েছে। সে ভয়ঙ্কর সন্ত্রাসী। তবে পল্লবী এলাকার কোনো বাসিন্দা আলীর বিরুদ্ধে কোনো অভিযোগ করবে না। হত্যার পরপরই পুলিশ লাশ নিয়ে অনেক অবহেলাও করেছে। দীর্ঘ সময় মরদেহ ঘটনাস্থলে পড়ে ছিল। আমরা পল্লবী থানায়ও যাইনি। খুনিদের গ্রেফতার করে আইনের আওতায় নেওয়া হোক_ এটাই আমাদের দাবি। তিনি আরও বলেন, টিটু পুলিশ এসআই এনামুলের বিশ্বস্ত লোক। সোর্স হিসেবে কাজ করে। তার দাবি, মোহাম্মদ আলীকে পরিকল্পিতভাবে হত্যা করা হয়েছে।

বাংলাদেশ