জীবনের ইতি টানতে সাউথ সিটির ছাদ

নিউজ ডেস্ক:

ব্যাগের ভিতরে একটি চিরকুট। তাতে শহরের পাঁচটি বহুতল ভবনের নাম লেখা। বাড়িগুলির কোনওটি অত্যাধুনিক আবাসন, কোনওটি বিলাসবহুল হোটেল। রয়েছে একটি রাষ্ট্রায়ত্ত তেল সংস্থার অফিসের নামও।
দক্ষিণ কলকাতার সাউথ সিটি আবাসনের জি ব্লকের ৩৪ তলার সিঁড়ির কাছে পড়ে ছিল ব্যাগটা। যে আবাসনের তলা থেকেই পাওয়া গিয়েছে তিন মহিলার মৃতদেহ। অশীতিপর মা আর পঞ্চাশোর্ধ্ব দুই মেয়ে। একসঙ্গে তিন জনেই উপর থেকে ঝাঁপ দিয়ে আত্মহত্যা করেছেন বলে প্রাথমিক তদন্তে পুলিশের অনুমান। ঝাঁপ দেওয়ার জন্য পাঁচটি বহুতলের তালিকা তৈরি করে শেষ পর্যন্ত সাউথ সিটিকেই বেছে নিয়েছিলেন ওঁরা।
বৃহস্পতিবার রাত আড়াইটে নাগাদ সাউথ সিটি আবাসনের রক্ষীরা উঁচু থেকে ভারী কিছু পড়ার আওয়াজ পেয়েছিলেন। ছুটে গিয়ে তাঁরা দেখেন, এক নম্বর টাওয়ারের পিছনে পড়ে রয়েছে তিন মহিলার রক্তাক্ত দেহ। পুলিশ পরে জানিয়েছে, মৃতেরা হলেন অমিতা মুখোপাধ্যায় (৮১) ও তাঁর দুই মেয়ে মুকুতা মুখোপাধ্যায় (৫৫) এবং খেয়া মুখোপাধ্যায় (৫১)। মুকুতা-খেয়া কেউই বিয়ে করেননি। বাবা নীহারকুমার মুখোপাধ্যায়কে নিয়ে চার জনের সংসার ছিল। বুধবার নীহারবাবু মারা যান। সেই শোকই বাকি তিন জনকেও মৃত্যুর দিকে ঠেলে দিল বলে প্রাথমিক ভাবে মনে করা হচ্ছে।

এমনই একটি ছাদ থেকে লাফ
প্রত্যক্ষদর্শীরা জানিয়েছেন, অমিতাদেবী এবং মুকুতার দেহ একটি ল্যাম্পপোস্টের উপরে পড়ে। সেটি ভেঙে নিয়েই মাটিতে পড়েন তাঁরা। অমিতাদেবীর পরনে ছিল শাড়ি। তার উপরে পড়েছিল মুকুতার দেহ। তাঁর পরনে জিনস-টপ। এর থেকে ফুট দশেক দূরে সালোয়ার-কামিজ পরা খেয়ার দেহ পড়েছিল। পুলিশের অনুমান, জি বা এইচ ব্লকের ছাদ থেকে ঝাঁপ দিয়েছিলেন ওঁরা। দু’টি ব্লকের মধ্যে করিডর রয়েছে। ময়নাতদন্তের রিপোর্ট অনুযায়ী, উপর থেকে পড়ার ফলে মুকুতার বাঁ পা দেহ থেকে আলাদা হয়ে যায়। এ দিন ঘটনাস্থলে দাঁড়িয়ে কলকাতার স্পেশ্যাল পুলিশ কমিশনার শিবাজী ঘোষ বলেন, ‘‘আবাসনের ছাদের দরজা খোলা ছিল। সেই সুযোগেই মহিলারা সেখানে পৌঁছেছিলেন বলে মনে করা হচ্ছে।” পরে আবাসনের আবাসনের ৩৪ তলার সিঁড়ির কাছে পাওয়া যায় ওই ব্যাগটি। তাতেই বিভিন্ন চিঠি-নথির মধ্যে ছিল ওই চিরকুটটিও। ওঁরা যে ঠান্ডা মাথায় রীতিমতো পরিকল্পনা করেই আত্মহত্যা করেছেন, ওই চিরকুটই তার প্রমাণ বলে মনে করছেন তদন্তকারীরা। কলকাতা পুলিশের গোয়েন্দাপ্রধান পল্লবকান্তি ঘোষ বলেন, “মহিলারা আত্মহত্যা করবেন বলে মনস্থির করে ফেলেছিলেন বলেই মনে হচ্ছে।”
পুলিশ সূত্রের খবর, ব্যাগের ভিতরে ওই চিরকুটটি ছাড়াও ছিল ওই পরিবারের একটি লিখিত বক্তব্য। সেখানে নীহারবাবু অসুস্থ হয়ে পড়ার পরেই ওঁদের অসহায় অবস্থার কথা লেখা রয়েছে। তা থেকেই পুলিশ মনে করছে, বুধবার ইএম বাইপাস সংলগ্ন একটি বেসরকারি হাসপাতালে নীহারবাবুর মৃত্যুর পর পরিবারটি মানসিক ভাবে ভেঙে পড়েছিল। ব্যাগের ভিতরে ওই দু’টি লিখিত নথি ছাড়াও দু’টি রাষ্ট্রায়ত্ত ব্যাঙ্কে কয়েক লক্ষ টাকার স্থায়ী আমানতের কাগজপত্র, বিভিন্ন ব্যাঙ্কের পাসবই, নীহারবাবুর ‘ডেথ সার্টিফিকেট’ ইত্যাদি মিলেছে। অমিতাদেবীরা নিজেদের সম্পত্তি রবীন্দ্রভারতী বিশ্ববিদ্যালয়কে দান করে গিয়েছেন। সম্পত্তি বলতে রয়েছে, ইএম বাইপাস সংলগ্ন তিন কাঠা জমি, একটি মারুতি জেন গাড়ি, গল্ফ গ্রিনের ফ্ল্যাট এবং তাঁদের জমানো টাকা-পয়সা। দানপত্রের প্রতিলিপিও ওই ব্যাগ থেকেই মিলেছে। পুলিশের অনুমান, মূল্যবান এই নথিগুলি সমেত ব্যাগটি ওঁরা ইচ্ছে করেই সিঁড়ির কাছে রেখে গিয়েছিলেন। তবে ব্যাঙ্কের কাগজপত্র থেকে মোবাইল নম্বর মিললেও কারওরই কোনও মোবাইল ফোন কিন্তু ঘটনাস্থলে পাওয়া যায়নি।

এখানেই পড়ে ছিল মৃতদেহগুলি।
কেন এমন চরম পদক্ষেপ করলেন অমিতা-মুকুতা-খেয়া? দুই বোনের কেউই কিন্তু এমনিতে ঠিক গড়পড়তা জীবন কাটাননি। বেহালা ফ্লাইং ক্লাব থেকে হাজার ঘণ্টা বিমান চালানোর অভিজ্ঞতা অর্জন করেছিলেন মুকুতা। কর্মাশিয়াল পাইলটের লাইসেন্স ছিল তাঁর। খেয়া ছিলেন টেবিল টেনিসের প্রশিক্ষক। খেলোয়াড়ের মনোবল তবে দু’জনেই হারিয়ে ফেললেন কী ভাবে? প্রাথমিক ভাবে মনে করা হচ্ছে, সংসারে নিজেরা চার জন ছাড়া আর তেমন নিকট কেউ ছিলেন না ওঁদের। বাবার মৃতু্যুর পরে তাই বাকি তিন জনও বাঁচার ইচ্ছা হারিয়ে ফেলে থাকবেন। শুক্রবার রাত পর্যন্ত পরিবারটির আত্মীয়-স্বজনদের কোনও খোঁজ মেলেনি। এ দিন বেলা এগারোটা পর্যন্ত মৃতদের পরিচয়ও মিলছিল না। ব্যাগটি উদ্ধার হওয়ার পর পুলিশ গল্ফ গ্রিন এলাকার বাসিন্দাদের সঙ্গে যোগাযোগ করে। তখন মুকুতাদের আবাসনের বাসিন্দারা এসে দেহগুলি শনাক্ত করেন।
গল্ফ গ্রিনের প্রতিবেশীরা জানিয়েছেন, পাড়ার লোকের সঙ্গে কিছুটা কথাবার্তা যা বলার মুকুতাই বলতেন। সম্প্রতি বাবা গুরুতর অসুস্থ হয়ে পড়ার পর থেকে তিনিও মানসিক ভাবে ভেঙে পড়েছিলেন। মুকুতা এমনিতে শহরে

মুকুতা মুখোপাধ্যায়। পরিবেশকর্মী হিসেবে পরিচিত ছিলেন। একটি স্বেচ্ছাসেবী সংস্থার সঙ্গে যুক্ত থেকে বিভিন্ন জলাশয় সংরক্ষণে তিনি উদ্যোগী ছিলেন। মুকুতার সহকর্মীরাও বলছেন, ইদানীং কাজে উৎসাহ হারিয়ে ফেলা বা অন্যমনস্ক হয়ে পড়ার মতো লক্ষণগুলি তাঁর আচরণে ফুটে উঠছিল। মনোরোগ বিশেষজ্ঞরা মনে করছেন, পরিবারের এক জনের থেকেই হয়তো বাকিদের মধ্যে মানসিক অবসাদের সংক্রমণ ঘটেছিল। আর তা থেকেই সুপরিকল্পিত আত্মহত্যার সিদ্ধান্ত।
বেশ কিছুদিন ধরেই ভুগছিলেন মুকুতা-খেয়ার বাবা, প্রাক্তন সরকারি কর্মী নীহারবাবু। বয়সও হয়েছিল নব্বইয়ের কাছাকাছি। মুকুতারা সম্ভবত বুঝেই গিয়েছিলেন, নীহারবাবু আর বাঁচবেন না। তাই আগেভাগেই সম্পত্তি দান করে যাওয়ার সিদ্ধান্ত নিয়ে নিয়েছিলেন। রবীন্দ্রভারতী বিশ্ববিদ্যালয়ের উপাচার্য সব্যসাচী বসুরায়চৌধুরী জানাচ্ছেন, গত ২৩ অগস্ট বিশ্ববিদ্যালয়ের জোড়াসাঁকো ক্যাম্পাসে গিয়েছিলেন মুকুতা ও খেয়া। সব্যসাচীবাবু বৈঠকে ব্যস্ত থাকায় ঘণ্টা খানেক অপেক্ষা করার পর তাঁর সঙ্গে দেখা করেন দু’বোন। তাঁরা উপাচার্যকে জানান, তাঁদের বাবা মৃত্যুশয্যায়। মা অমিতাদেবী রবীন্দ্রনাথের চিন্তা এবং চেতনার বিকাশের জন্য তাঁদের সম্পত্তির একাংশ বিশ্ববিদ্যালয়কে দান করতে চান। ২৯ অগস্ট তাঁরা একটি দরখাস্তের সঙ্গে সম্পত্তির কাগজপত্র জুড়ে বিশ্ববিদ্যালয়কে দান করে আসেন। সব্যসাচীবাবু বলেন, “২৩ তারিখেই ওঁদের মধ্যে একটি তাড়া লক্ষ করেছিলাম। ওঁরা চাইছিলেন সব কাজ খুব দ্রুত করা হোক।”
বুধবার দুপুরে একটি বেসরকারি হাসপাতালে মৃত্যু হয় নীহারবাবুর। হাসপাতাল সূত্রে জানা গিয়েছে, মুকুতারা অনুরোধ করেন, দেহটি আরও ২৪ ঘণ্টা হাসপাতালেই রাখা হোক। বৃহস্পতিবার বিকেলে কেওড়াতলা শ্মশানে নীহারবাবুর অন্ত্যেষ্টি করেন ওঁরা। তার কিছু ক্ষণ পর থেকেই পরিকল্পনা মাফিক জীবনের শেষ অঙ্কে ঢুকে পড়েন ওঁরা। শুরু হয়ে যায় মরণ ঝাঁপের প্রস্তুতি।
পুলিশ জানিয়েছে, রাত পৌনে আটটা নাগাদ মারুতি গাড়ি চালিয়ে তিন জনে চলে আসেন সাউথ সিটি আবাসনে। কিছুক্ষণ পরে তাঁরা সেখান থেকে চলে যান। রাত দশটা নাগাদ তিন জন ফের গাড়ি চালিয়ে ফিরে আসেন। গাড়িটি চালাচ্ছিলেন খেয়া। আবাসনের মূল ফটকের রেকর্ড থেকে দু’বারই গাড়ি ঢোকার সাক্ষ্য মিলেছে। সিসিটিভি ফুটেজ থেকে দেখা গিয়েছে, রাত পৌনে বারোটা নাগাদ মুকুতা এক নম্বর টাওয়ারের রিসেপশনে আসেন। খেয়া বা অমিতাকে টিভিতে দেখা যাচ্ছে না। মুকুতাই সইসাবুদ সেরে ভিতরে চলে যান। তবে খাতায় তাঁর সঙ্গে আরও দু’জনের ঢোকার উল্লেখ রয়েছে।
কিন্তু প্রশ্ন হল, রাত দশটায় গাড়ি নিয়ে ঢোকার পরে পৌনে বারোটা পর্যন্ত রিসেপশনে না এসে মুকুতারা কোথায় ছিলেন? সাউথ সিটির মতো একটি অভিজাত আবাসনে সেটা সম্ভবই বা হল কী করে? আবাসিকদের একাংশের অভিযোগ, এর একটাই অর্থ। আবাসনের নিরাপত্তায় ফাঁক রয়েছে। যদিও আবাসিক কমিটি অভিযোগ মানতে চায়নি। কমিটির সম্পাদক সুবীর খাসনবিশ বলেন, “নিরাপত্তা যথেষ্ট রয়েছে। কিন্তু এ ধরনের ঘটনার পর তা আরও কড়া করতে হবে।”
নিরাপত্তারক্ষীদের জিজ্ঞাসাবাদ করে পুলিশ জেনেছে, মুকুতাদেবী রিসেপশনে এসে জি এবং এইচ ব্লকের ৩৩ তলায় একটি রাষ্ট্রায়ত্ত তেল সংস্থার অতিথিশালায় যাওয়ার কথা বলেছিলেন। ওই অতিথিশালার কেয়ারটেকারকে ‘ইন্টারকম’-এ তা জানানো হয়। তিনি মুকুতাদের ভিতরে পাঠানোর কথা বলেন। তবে মুকুতারা সেখানে পৌঁছেছিলেন কি না, সেটা নিরাপত্তারক্ষীরা লক্ষ করেননি। পুলিশের কাছে কেয়ারটেকার দাবি করেছেন, তাঁর কাছে কেউ আসেননি। সে ক্ষেত্রে রাত পৌনে বারোটা থেকে আড়াইটে পর্যন্ত মুকুতারা কোথায় ছিলেন, সেটাও এখনও জানা যায়নি।
মুকুতাদের স্টিল রংয়ের মারুতি জেন এ দিন বিকেল পর্যন্ত সাউথ সিটির ভিজিটর্স পার্কিংয়েই পড়েছিল। বিকেলে তার দখল নেয় পুলিশ। গল্ফ গ্রিনের ফ্ল্যাট এখনও বন্ধ। আবাসিকরা কেউই আর ফেরেননি যে!

আন্তর্জাতিক