সমঝোতা এখন বহুদূরের বাদ্যযন্ত্রের আওয়াজ বলেই মনে হচ্ছে।

সমঝোতা এখন বহুদূরের বাদ্যযন্ত্রের আওয়াজ বলেই মনে হচ্ছে।

69865_adখুব সম্ভবত মে মাসের কথা। পর্দার অন্তরালে আলোচনা চলছিল সরকার এবং বিরোধী নেতাদের মধ্যে। প্রধানমন্ত্রীর উপদেষ্টা ড. গওহর রিজভীর বাসায় অপেক্ষা করছিলেন বিএনপির স্থায়ী কমিটির এক সদস্য এবং দলটির চেয়ারপারসনের এক উপদেষ্টা। ওই বৈঠকে যোগ দেয়ার কথা ছিল আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক সৈয়দ আশরাফুল ইসলামের। রওনাও দিয়েছিলেন তিনি। কিন্তু একটি ফোনকল তার গতিরোধ করে দেয়। পর্দার অন্তরালে সমঝোতা প্রচেষ্টা বড় হোঁচট খায় সেদিনই এবং হয়তো সমঝোতার পথে সিলমোহর মেরে দেয়া হলো সোমবার। যেদিন প্রধানমন্ত্রী স্পষ্ট জানালেন, সংসদ আর মন্ত্রিসভা বহাল রেখেই নির্বাচন হবে। যদিও তিনি এও বলেছেন, ২৭শে অক্টোবরের পর আর সংসদ অধিবেশন আহ্বান করা হবে না। মন্ত্রিসভাও নীতিনির্ধারণী কোন সিদ্ধান্ত নেবে না।
প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার সর্বশেষ অবস্থানের পর বাংলাদেশে সমঝোতার রাজনীতি আরও কঠিন হয়ে গেল। নির্বাচনকালীন সময়ে সংসদ ভেঙে দেয়া নিয়ে সরকারের ভেতরে আলোচনা চলছিল। এর আগে সরকারের শীর্ষ পর্যায় থেকেও বলা হয়েছিল, সংসদ রেখে তো আর নির্বাচন হবে না। ছোট মন্ত্রিসভা গঠন নিয়ে আইনমন্ত্রী ব্যারিস্টার শফিক আহমেদ সরকারের নীতিনির্ধারকদের সঙ্গে কথা বলেছেন। আইনমন্ত্রীর দপ্তর এবং বাসায় এ নিয়ে কমপক্ষে দুটি বৈঠক হয়েছিল। এমনকি এও শোনা গিয়েছিল, মন্ত্রিসভার অর্ধেক সদস্য বিরোধী দল থেকে নেয়া হবে। কিন্তু সরকারের সর্বশেষ অবস্থান রাজনীতিকে পয়েন্ট অব নো রিটার্নে নিয়ে গেছে। সমঝোতা এখন বহুদূরের বাদ্যযন্ত্রের আওয়াজ বলেই মনে হচ্ছে। সাবেক উপদেষ্টা ড. আকবর আলি খানের মতে, সমঝোতার জন্য সময়ও এখন কমে এসেছে, যা করার অক্টোবরের মধ্যেই করতে হবে। যদিও তিনি স্পষ্টই বলেছেন, বাংলাদেশে বর্তমান সঙ্কট আইগনত বা শাসনতান্ত্রিক সঙ্কট নয়। এটি একটি রাজনৈতিক সঙ্কট। জাতিসংঘ মহাসচিব বান কি মুন দুই নেত্রীর সঙ্গে টেলিফোনে কথা বলার পর অনেকেই আশা করেছিলেন বরফ হয়তো গলা শুরু করবে। এর আগে জাতিসংঘের একজন বিশেষজ্ঞের ঢাকা সফরের কথাও জানা যায়। যে সফরের সময় তিনি তত্ত্বাবধায়ক সরকার ব্যবস্থা নিয়ে একজন সাবেক প্রধান বিচারপতির সঙ্গেও আলোচনা করেন।
আওয়ামী লীগের সর্বশেষ অবস্থানের কারণে বিরোধীদলীয় নেতা বেগম খালেদা জিয়ার সামনে বিকল্প আরও কমে গেছে। তিনি আলোচনার জন্য জাতিসংঘে কোন প্রতিনিধি পাঠান কিনাÑ তা-ই এখন দেখার বিষয়। জাতিসংঘ শেষ পর্যন্ত বাংলাদেশের নির্বাচনে কতটুকু হস্তক্ষেপ করে তা দেখার জন্যও আমাদের অপেক্ষায় থাকতে হবে। আর রাজপথে খালেদা জিয়ার নেতৃত্বে বিএনপি কোন আন্দোলন গড়ে তুলতে পারে কিনা পর্যবেক্ষকরা দৃষ্টি রাখবেন সে দিকেও।
পঞ্চদশ সংশোধনী বাংলাদেশের রাজনীতিতে অদ্ভুত কিছু সমস্যা আমদানি করেছে। সংসদ রেখে সংসদ নির্বাচনের বিধান তারই একটি নমুনা মাত্র। পঞ্চদশ সংশোধনীতে ১২৩(৩) অনুচ্ছেদ ক্ষমতাসীনরা কেন যুক্ত করলেন তা স্পষ্ট নয়। যেখানে বলা হয়েছে, ‘(৩) সংসদ সদস্যদের সাধারণ নির্বাচন অনুষ্ঠিত হইবে ক) মেয়াদ অবসানের কারণে সংসদ ভাংগিয়া যাইবার ক্ষেত্রে ভাংগিয়া যাইবার পূর্ববর্তী নব্বই দিনের মধ্যে; এবং খ) মেয়াদ অবসান ব্যতীত অন্য কোন কারণে সংসদ ভাংগিয়া যাইবার ক্ষেত্রে ভাংগিয়া যাইবার পরবর্তী নব্বই দিনের মধ্যে।’ অন্যান্য গণতান্ত্রিক দেশে সংসদ বহাল রেখে সংসদ নির্বাচন হয় কিনা, তার পরীক্ষা আমরা করবো। রাজারা তাদের ক্ষমতা প্রয়োগের কেন্দ্র হিসেবে সংসদ প্রতিষ্ঠা করেছিলেন। যে কারণে তারা সংসদ ভাঙতে চাইতেন না। কিন্তু একসময় সংসদ পরিণত হয় জনগণের ক্ষমতার প্রতীকে। বৃটেনে রাজা জেমস টানা ১৭ বছর সংসদের অধিবেশন ডাকেননি। এ কারণে সংসদের মেয়াদ নির্দিষ্ট করে আইন পাস হয়। ৩০০ বছর ধরে বৃটেনে সব সময়ই সংসদ ভেঙেই নির্বাচন হয়েছে। কখনই তার ব্যতিক্রম হয়নি। ইউরোপের অন্য কোন গণতান্ত্রিক দেশের সংসদ নির্বাচন সংসদ বহাল রেখে হয় না। মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের চিত্রও একই। সংবিধানের ১২৩(৩) অনুচ্ছেদ সাক্ষ্য দিচ্ছে, ওয়েস্ট মিনিস্টার ধাঁচের যে নির্বাচনের কথা বলা হচ্ছে তা সত্য নয়। সভ্য-অসভ্য পৃথিবীর কোন গণতান্ত্রিক দেশেই সংসদ বহাল রেখে সংসদ নির্বাচন অনুষ্ঠিত হয় না।
আশার আলো একে একে নিভে আসছে। সমঝোতা সুদূর পরাহত বলেই মনে হচ্ছে। টেবিলে সঙ্কট সমাধানের রেকর্ড বাঙালির নেই। যে কারণে ৬০ বছরের সাংবাদিকতার অভিজ্ঞতাসম্পন্ন সাংবাদিক এবিএম মূসা অনেক আগেই বলেছিলেন, তত্ত্বাবধায়ক সঙ্কটের সমাধানও রাজপথেই হবে। যদিও রাজপথে বিএনপির তত্ত্বাবধায়ক সরকার আদায়ের সামর্থ্য আছে কিনা তা নিয়ে কারও কারও সংশয় আছে।
রাজনীতির কারবারিরা চাচ্ছেন সংঘাত এবং নিশ্চিতভাবেই রাজনীতি সে পথে এগোচ্ছে। ভাল, ভাল তো, ভাল না?    সুত্র ঃ মানবজমিন
বাংলাদেশ