মুসলমানদের কাছে অতি পবিত্র একটি নিদর্শন জমজম কূপ। পবিত্র মক্কা নগরীতে কাবা শরিফের অনতিদূরে অবস্থিত ইসলামের ইতিহাসের অমর সাক্ষী জমজম কূপ। অনেকে একে আবে জমজম কূপ বলেন। এ কূপের পবিত্র পানি নেক নিয়তে পান করলে আল্লাহ তার মনের বাসনা পূর্ণ করেন। রোগ থেকে মুক্তি দেন। এ কূপের রয়েছে যেমন সৃষ্টির এক মর্মস্পর্শী কাহিনী, তেমনি রয়েছে এর অলৌকিক অনেক মাজেজা। সৃষ্টির শুরু থেকে প্রতিদিন এ কূপ থেকে গড়ে ৬৯ কোটি ১২ লাখ লিটার পানি উত্তোলন করা হচ্ছে। কিন্তু কূপের পানি এক বিন্দুও কমে নি। অলৌকিকত্বের মধ্যে কূপে সব সময় পানি ভরে যাচ্ছে। এ এক অলৌকিক ঘটনা। একটি দিনের জন্য পানিশূন্য হয় নি জমজম কূপ। হজযাত্রীরা হজ করতে গিয়ে মনের পবিত্র ইচ্ছা নিয়ে পান করেন এ কূপের পানি। তারা সাফা-মারওয়া পাহাড়ের মধ্যে দৌড়ান। এর সঙ্গে জড়িয়ে আছে ইসলামের ইতিহাসের এক কাহিনী। তা হলো- নবী ইব্রাহিম (আ.)-এর কোন সন্তান হচ্ছিল না। তিনি একটি সন্তানের জন্য আকুল হয়ে পড়লেন। তখন তার বয়স ৮৬ বছর। ঘরে স্ত্রী হাজেরা (আ.)। তার গর্ভে আল্লাহ দান করলেন একটি পুত্রসন্তান। তার নাম রাখলেন ইসমাইল। তাকে পেয়ে যেমন খুশি ইব্রাহিম, তেমনি খুশি বিবি হাজেরা। এ সময় আল্লাহর নির্দেশে হযরত ইব্রাহিম (আ.) তার আদরের ছেলে ইসমাইল ও বিবি হাজেরাকে নিয়ে রওনা দিলেন পবিত্র মক্কা নগরীর দিকে। তখন মক্কায় কোন জনবসতি ছিল না। চারদিকে শুধু মরুভূমি। এখানে-ওখানে পাহাড়। আজ মক্কা নগরীতে পরিণত হয়েছে। বিশ্ব মুসলিমের মিলনমেলায় পরিণত হয়েছে। সারাক্ষণ ধর্মপ্রাণ মুসলমানরা তাওয়াফ করছেন পবিত্র কাবাঘর। অদৃশ্য এক কান্না ঝরছে তাদের হৃদয়ে। দীর্ঘ সময় পথ চলতে চলতে হযরত ইব্রাহিম, বিবি হাজেরা ও শিশুপুত্র ইসমাইল এসে পৌঁছলেন মক্কায়। স্ত্রী ও সন্তানের জন্য সঙ্গে নিয়েছিলেন এক ব্যাগ খেজুর ও চামড়ার একটি ভাঁড়ে কিছু পানি। ঘটনাস্থলে পৌঁছে স্ত্রী ও সন্তানকে উট থেকে নামতে বললেন হযরত ইব্রাহিম। তারা উট থেকে নামার পর হযরত ইব্রাহিম পেছন ফিরে বাড়ির দিকে রওনা হলেন। প্রথমে বিবি হাজেরা কিছু বুঝে উঠতে পারলেন না। কিছুক্ষণ পরে তিনি পেছন থেকে হযরত ইব্রাহিমকে ডাকলেন- ও প্রিয় স্বামী আপনি আমাদেরকে এই জনমানবশূন্য উপত্যকায় নিঃসঙ্গ ফেলে যাচ্ছেন কেন? এখানে তো কোন পানি নেই। খাবার নেই। নেই কোন মানুষজন। তার এ ডাকে সাড়া দিলেন না হযরত ইব্রাহিম। তিনি সামনের দিকে চলতেই লাগলেন। এ অবস্থায় হযরত ইব্রাহিম বার বার একইভাবে ডাকতে লাগলেন তাকে। কিন্তু আল্লাহর হুকুম না থাকায় তিনি পিছন ফিরে তাকাতে পারলেন না। তখন হযরত ইব্রাহিম অনেকটা দূরে চলে এসেছেন। আবার হযরত হাজেরা তাকে একইভাবে ডাকলেন। এবার তিনি মুখে কোন কথা না বলে সম্মতিসূচক মাথা নাড়লেন। বিবি হাজেরা তার জবাব পেয়ে গেলেন। তিনি ধরে নিলেন, নবী ইব্রাহিম (আ.) তাদেরকে এই ঊষর মরুর বুকে ফেলে যাচ্ছেন আল্লাহর ইচ্ছায়। যে আল্লাহর ইচ্ছায় তিনি তাদেরকে এখানে ফেলে যাচ্ছেন নিশ্চয়ই সেই আল্লাহ তাদের উত্তম অভিভাবক। তিনিই দেখবেন তাদেরকে। হাজেরা বললেন, আল্লাহর ইচ্ছায় আমাদেরকে এখানে ফেলে যাচ্ছেন। সুতরাং আমরা পরাজিত হবো না। আল্লাহ নিশ্চয়ই আমাদেরকে দেখবেন। স্ত্রী ও সন্তানকে ফেলে রেখে হযরত ইব্রাহিম আরও সামনের দিকে এগিয়ে গেলেন। তিনি এতক্ষণ পেছন ফিরে স্ত্রী ও সন্তানের দিকে তাকান নি। এবার অনেকটা দূরে এসে তিনি পেছনে তাকালেন। না, এখন আর তার সন্তান ও স্ত্রীকে দেখা যাচ্ছে না। তিনি পেছন ফিরে সেখানে দাঁড়িয়ে আল্লাহর কাছে মোনাজাত করলেন- হে আল্লাহ! আপনার পবিত্র ঘরের কাছে বিরান উপত্যকায় রেখে যাচ্ছি আমার স্ত্রী ও সন্তানকে, যাতে তারা আপনার প্রার্থনা করতে পারে। হে আল্লাহ! তুমি তাদের প্রতি অন্যরা যাতে অনুগামী হয় এমন করে দাও। তাদেরকে খাদ্যের ব্যবস্থা করো, যার জন্য তারা তোমার শুকরিয়া আদায় করবে। এ অবস্থায় শিশু ইসমাইলকে নিয়ে সেই নিঃসঙ্গ মরুতে দিন কাটাতে লাগলেন বিবি হাজেরা। আস্তে আস্তে তাদের খাবার ও পানি ফুরিয়ে আসে। খাদ্যে ঘাটতি দেখা দেয়ায় মা হাজেরার বুকে দুধ কমে আসতে থাকে। যে সামান্য পানি সঙ্গে এনেছিলেন তাও ফুরিয়ে যাচ্ছে। শিশু ইসমাইল ঠিকমতো মা’র দুধ না পেয়ে কান্নাকাটি করে। তার কান্না সহ্য করতে পারেন না মা হাজেরা। সন্তানের কান্না দেখে মায়ের মন ব্যাকুল হয়ে ওঠে। তিনি নিরুপায় হয়ে পড়েন। একপর্যায়ে অবস্থা এমন হলো যে, খাবার ও পানি ফুরিয়ে যাওয়ায় মা হাজেরার বুকের দুধ একেবারে শুকিয়ে যায়। ফলে শিশু ইসমাইল মা’র দুধ পান করতে গিয়ে তার স্বরে কান্না করেন। ঠিকমতো খাবার না পেয়ে তার বুকের হাড় বেরিয়ে পড়তে থাকে। এ সময় আর স্থির থাকতে পারেন না মা হাজেরা। কাছেই ছিল সাফা পাহাড়। সেখানে গেলে হয়তো কারো সহায়তা পাওয়া যাবে, কোন মানুষের সন্ধান মিলবে- এমন আশায় তিনি আরোহণ করলেন সাফা পাহাড়ের চূড়ায়। এদিক-ওদিক তাকালেন। কিন্তু না, যে আশা নিয়ে তিনি এখানে উঠেছেন তার সে আশা পূরণ হলো না। তিনি নিচে তাকালেন। কোথাও কোন জনমানব নেই। নেই কোন খাবারের ব্যবস্থা। তিনি উতলা হয়ে উঠলেন। এখন কি করবেন। তার ইসমাইল যে অভুক্ত। পানি নেই। খাবার নেই। তার নিজেরও একই অবস্থা। তিনি স্থির থাকতে পারলেন না। সাফা পাহাড় থেকে নেমে এলেন উপত্যকায়। পাশেই দেখতে পেলেন মারওয়া পাহাড়। একই আশা নিয়ে ছুটে গেলেন সেখানে। মারওয়ার চূড়ায় আরোহণ করে দেখলেন কোথাও কিছু নেই। কার কাছে তিনি এখন সহায়তা পাবেন। তিনি উতলা হয়ে উঠলেন। মায়ের মন। কোনভাবে নিজেকে ধরে রাখতে পারলেন না। তিনি সেখান থেকে সমতলে নেমে এলেন। আবার দৌড়ে গেলেন সাফার চূড়ায়। সেখান থেকে আবার মারওয়া পাহাড়ে। এভাবে সাতবার তিনি দৌড়ালেন সাফা-মারওয়ায়। শেষ বার যখন তিনি মারওয়া পাহাড়ে আরোহণ করলেন তখন শুনতে পেলেন এক গায়েবি আওয়াজ- ‘সাহায্য কর, যদি তুমি পার’। এ আওয়াজ আর কারো নয় স্বয়ং ফেরেশতা জিবরাইল (আ.)-এর পক্ষ থেকে পাঠানো হলো। মা হাজেরা ফিরে এলেন ইসমাইলের কাছে। দেখতে পেলেন ক্ষুধায় ক্লান্ত, পানির পিপাসায় কাতর ইসমাইল এখন খেলছে। তার মুখে হাসি। অতি স্বাভাবিক সে। আর দেখলেন তিনি ছোট্ট পা দিয়ে মাটিতে যেখানে আঘাত করছেন সেখানে মাটি ফেটে বেরিয়ে আসছে পানি। এই পানির ফোয়ারা বের করতে সহায়তা করেন হযরত জিবরাইল (আ.)। তিনিই মাটি খুঁড়ে খুঁড়ে পানি বের করে দেন। এই পানি বের হয়ে আসতে থাকে ফল্গুধারায়। তা দেখে বিবি হাজেরারও যেন আনন্দ আর ধরে না। তিনি হাতের তালুবন্দি করে পানি তুলে তা পান করলেন। পিপাসা নিবারণ করলেন। সন্তান ইসমাইলকে দান করলেন দুধ। এ জন্য তিনি আল্লাহর প্রতি শুকরিয়া আদায় করলেন। বালু, কাদা দিয়ে এই ফোয়ারার চারদিকে বাঁধ দিয়ে দেন তিনি। যাতে এ পানি ছড়িয়ে পড়তে না পারে। পানি সেই বাঁধকে ভাঙে নি। কুদরতি সেই ফোয়ারা, আর বাঁধ মিলে সৃষ্টি হলো জমজম কূপ। এর কিছু পরে ইয়েমেন থেকে জুরহুম গোত্রের কিছু মানুষ যায় মক্কায়। সেখানে তারা বসবাস শুরু করে। তাদের একজনকে বিয়ে করেন হযরত ইসমাইল (আ.)। পবিত্র কাবা দেখাশোনার সম্মান অর্জন করেন ইসমাইল। এরপর এ দায়িত্ব পান জুরহুম গোত্র। এক সময় এসব মানুষ পবিত্র নগরীর পবিত্রতা লঙ্ঘন করতে শুরু করে। তখন একেবারে শুকিয়ে যায় জমজম কূপ। তাদেরকে শাস্তি দেয়ার জন্য এমন ঘটনা ঘটে। এমনকি জমজম কূপ কোথায় ছিল সেই চিহ্নটি পর্যন্ত খুঁজে পাওয়া যেত না। কয়েক শতাব্দী ধরে মানুষ চিহ্নিত করতে পারে নি যে জমজম কূপ কোন স্থানে ছিল। পরে জমজম কূপের অবস্থান শনাক্ত করেন মহানবী হযরত মুহাম্মদ (সা.)-এর দাদা আবদুল মুত্তালিব।
মহানবী (সা.)-এর বক্ষ ধৌতকরণ
মহানবী হযরত মুহাম্মদ (সা.) তখন কিশোর। তিনি দুধ-মা হালিমার ঘরের কাছে অন্য ছেলেদের সঙ্গে খেলছিলেন। তখন সেখানে হাজির হন হযরত জিবরাইল (আ.)। তিনি মহানবীকে উপুর করে শোয়ালেন। তিনি মহানবীর বক্ষ উন্মুক্ত করলেন। তার হৃৎপিণ্ড বাইরে বের করে আনলেন। তা থেকে এক খণ্ড মাংস ফেলে দিলেন এবং বললেন, ‘আপনার ভিতরে এই অংশটি ছিল শয়তান’। এরপর তিনি মহানবী (সা.)-এর হৃৎপিণ্ড একটি স্বর্ণের পাত্রে রাখলেন। তাতে ভরা ছিল জমজম কূপের পানি। তা দিয়ে ধুয়ে দিলেন নবীজির হৃৎপিণ্ড। তারপর তা বসিয়ে দিলেন বুকের যথাস্থানে।
জমজমের ক্ষমতা
জমজম পানির রোগমুক্তি দেয়ার ক্ষমতা আছে। ইবনে আব্বাস (রা.) বলেন, মহানবী (সা.) বলেছেন, পৃথিবীর সবচেয়ে উত্তম পানি হলো জমজমের পানি। এতে রয়েছে পূর্ণাঙ্গ খাদ্য উপাদান ও রোগ থেকে মুক্তি দেয়ার ক্ষমতা। জাবির (রা.) বলেন, আমি মহানবী (সা.)কে বলতে শুনেছি যে, যেকোন রোগমুক্তির নিয়ত করে জমজমের পানি পান করলে রোগমুক্তি মেলে। আরেক হাদিসে বলা হয়েছে, যদি তুমি তৃষ্ণা নিবারণের জন্য এই পানি পান কর তাহলে তৃষ্ণা দূর হবে। যদি পুরো পেটপুরে এই পানি পান করো খাদ্যের পরিবর্তে তাহলে তা খাদ্যের পরিপূরক হবে। যদি তুমি রোগমুক্তির জন্য এই পানি পান করো তাহলে তুমি রোগমুক্তি পাবে।
আরাফাত ময়দান
পবিত্র মক্কা নগরী থেকে পূর্বদিকে অবস্থিত আরাফাত পাহাড়। কেউ কেউ একে জাবাল আরাফাত বলেও চেনেন। আরাফাত উপত্যকায় অবস্থিত এ পাহাড়। এ সেই স্মৃতিধন্য পাহাড় যেখানে দাঁড়িয়ে মহানবী হযরত মুহাম্মদ (সা.) তার বিদায় হজের ভাষণ দিয়েছিলেন। জীবনের শেষ দিকে তিনি যে হজ করেন তখন এ পাহাড়ে দাঁড়িয়ে দিয়েছিলেন ঐতিহাসিক বিদায় হজের ভাষণ। তাই আরাফাত দিবসে হজযাত্রীরা সারা দিন অবস্থান করেন এ ময়দানে। তারা এদিন আল্লাহর ইবাদতে মগ্ন থাকেন। এরপর সংগ্রহ করেন পাথর। সেই পাথরই পরে শয়তানকে লক্ষ্য করে নিক্ষেপ করেন। এ আরাফাতের ময়দানে রয়েছে ঐতিহাসিক নামিরা মসজিদ। এখান থেকেই সমবেত হজযাত্রীদের উদ্দেশে খুতবা দেয়া হয়। পাহাড়বেষ্টিত যে উপত্যকা তার পুরোটাকেই বলা হয় আরাফাতের ময়দান। তবে কখনও কখনও এ এলাকাটিকে অনেকে আরাফাত পাহাড় হিসেবে অভিহিত করে থাকেন। ইসলামে আরাফাতের ময়দানের রয়েছে অসীম গুরুত্ব। কারণ, হজের সময় হজযাত্রীরা ৯ই জিলহজ তারিখে সারা দিন কাটান এ ময়দানে। এদিন লাখ লাখ হজযাত্রীর পদচারণায় আর সমবেত কণ্ঠে ‘লাব্বায়েক আল্লাহুম্মা লাব্বায়েক’ ধ্বনিতে মুখরিত হয়ে ওঠে পুরো আরাফাত। তাদের পরনে সাদা কাপড়। ইহরাম বাঁধা হজযাত্রীরা যেন দুনিয়ার সবকিছুকে পেছনে ফেলে এক আল্লাহর প্রেমে মশগুল হয়ে পড়েন। অত্যন্ত উত্তাপে যাতে তাদের কষ্ট না হয় সে জন্য সৌদি আরব সরকার সেখানে কৃত্রিম উপায়ে বাষ্পপানি ছিটিয়ে দেয়ার ব্যবস্থা করেছে। লাগানো হয়েছে গাছ। এ বছর শক্ত-সামর্থ্য ৬০ হাজারেরও বেশি নিরাপত্তা সদস্যকে মোতায়েন করেছে সৌদি কর্তৃপক্ষ। এছাড়া পবিত্র স্থান সমূহ ছাড়াও দেশজুড়ে হাজার হাজার সিসিটিভি ক্যামেরা স্থাপন করা হয়েছে। সেই সঙ্গে মুখমণ্ডল শনাক্তের প্রযুক্তিও সংযোজিত হয়েছে। হাজীদের নিরীক্ষণ ও স্বাস্থ্য পরীক্ষায় ব্যবহৃত হবে নতুন ইলেকট্রনিক ব্যবস্থা।