টেস্ট ক্রিকেটের একশো চৌত্রিশ বছরের ইতিহাস যা দেখেনি !

 নিউজ ডেস্ক:  টেস্ট ক্রিকেটের একশো চৌত্রিশ বছরের ইতিহাস যা দেখেনি, তা শেষ পর্যন্ত দেখল কি না শুক্রবারের চিন্নাস্বামী!
আজ পর্যন্ত টেস্ট ক্রিকেটে কোনও দিন বাঁ-হাতি স্পিনারকে দিয়ে বোলিং ওপেন করাননি কোনও অধিনায়ক। প্রজ্ঞান ওঝাকে দিয়ে সে কাজ করিয়ে ভারত অধিনায়ক মহেন্দ্র সিংহ ধোনি নতুন স্ট্র্যাটেজির জন্ম দিলেন তো বটেই, একই সঙ্গে নতুন প্রশ্নও উঠে গেল তাঁর সিদ্ধান্তকে ঘিরে।
কেন? গত দিনই প্রবল ক্ষুব্ধ ভারত অধিনায়ক জানিয়েছিলেন, চিন্নাস্বামীর উইকেট মোটেই ‘টার্নার’ নয়। এমনকী বোর্ডের কাছে বারবার চেয়েও দেশের মাঠে নাকি ঘূর্ণি উইকেট টিম ইন্ডিয়া পাচ্ছে না। অথচ সেই ধোনি-ই কিনা টস হেরে ওঝাকে ডেকে বলে দিলেন, “ম্যাচের প্রথম ওভারটা তুমি করছ!” সকাল সাড়ে ন’টায় ধোনির সিদ্ধান্ত দেখে প্রেসবক্স হতবাক। মাথার উপর মেঘলা আকাশ, সিমারদের জন্য আদর্শ পরিবেশ, তা ছাড়া ধোনির কথা ধরলে পিচ ‘টার্নার’ নয়। সেক্ষেত্রে কোন যুক্তিতে শুরুতেই ওঝা? তা হলে এটা কি ভারত অধিনায়কের প্রতিবাদ? পরোক্ষ ভাবে বোর্ডকে ভারত অধিনায়কের বুঝিয়ে দেওয়া যে, ‘টার্নার’ দাও চাই না দাও, আমার আসল অস্ত্র স্পিনই হবে? ক্রিকেটমহলের কারও কারও মতে অবশ্য, উইকেটের আর্দ্রতার ফায়দা তুলতে গিয়ে সিদ্ধান্তটা নিয়েছিলেন ধোনি। পরে প্রজ্ঞান ওঝাও বলে গেলেন, “ধোনির প্ল্যান ছিল পিচের আর্দ্রতাটা কাজে লাগানো। তাই আমাকে বল দিয়েছিল। আমি চ্যালেঞ্জটা নিয়েছি।” চিন্নাস্বামীর উইকেট পুরোদস্তুর ‘টার্নার’ নয় ঠিকই, তবে স্পিনারদের শোকসভা বসানোর মতোও নয়। হায়দরাবাদের অশ্বিন আর বেঙ্গালুরুর অশ্বিনের মধ্যে ফারাক রইল, কিন্তু তাঁর বল ঘোরেনি এমন অভিযোগ এই অফ স্পিনার নিজেও তুলতে পারবেন না। আর ওঝা তো প্রথম দিনই চার-চারটে উইকেট দিব্যি ব্যাগে ভরে ফেললেন। পড়ে রইলেন শুধু ব্যাটসম্যানরা। এবং পিচ তাঁদেরও বধ্যভূমি নয়। রস টেলরের সেঞ্চুরি ছাড়াও দু’টো হাফসেঞ্চুরি কিউয়িদের ইনিংসে আছে। এক কথায়, টেস্ট ক্রিকেটের জন্য ঠিকঠাক উইকেট।

নতুন বলে ওঝা। শুক্রবারের চিন্নাস্বামীতে। ছবি: পিটিআই
বরং খারাপ লাগতে পারে চিন্নাস্বামীর হাজার সাতেক দর্শকের কথা ভেবে। অশ্বিনের স্পিনের বশীকরণ মন্ত্রে নয়, বিকেল পর্যন্ত চিন্নাস্বামীকে ডুবে থাকতে হল রস-রোম্যান্সে। নিখাদ ক্রিকেটপ্রেমীর কাছে যদিও তা মনখারাপের কারণ হওয়া উচিত নয়। ‘মার্ডারার’, ‘ফিনিশার’, ‘পাল্লেকেলে প্লান্ডারার’, কম বিশেষণ জোড়েনি কিউয়ি অধিনায়কের আঠাশ বছরের ক্রিকেটজীবনের সঙ্গে। দুর্ভাগ্য টেলরের, অসম্ভব প্রতিভাবান হয়েও এমন এক দেশের প্রতিনিধিত্ব তাঁকে করতে হচ্ছে, যারা কিনা ক্রিকেটদুনিয়ায় তৃতীয় বিশ্বের নাগরিক। এই অবস্থায় টিমের সীমিত শক্তি মাথায় রেখে অশ্বিনদের স্পিনের বিরুদ্ধে যে পাল্টা যুদ্ধ চালু করলেন টেলর, তার পাশে প্রশংসার যে কোনও বিশেষণকে খাটো শোনাবে। টেলর কথা দিয়েছিলেন, টেস্ট ক্রিকেটের গোঁড়া নিয়ম ভেঙে ঠান্ডা মাথায় আগাগোড়া ‘খুন’ করবেন ভারতীয় স্পিনকে। কথা রেখেছেন। কিন্তু সেটা যে এ ভাবে হবে, বোঝা যায়নি।
৪৭ বলে হাফসেঞ্চুরি। ১৬-টা বাউন্ডারি আর দু’টো ছক্কা মিলিয়ে ১২৭ বলে ১১৩! শুক্রবার টিভি খুলে যাঁরা বসেছিলেন, বারবার যে তাঁদের চোখ কচলাতে হয়েছে, তাতে আর সন্দেহ কী? টেস্ট কোথায়, এ তো টি-টোয়েন্টির মেজাজে ব্যাটিং! যার শুরুটাই হল অশ্বিনকে সোজা মাঠের বাইরে ফেলে দেওয়া দিয়ে। জাহিরের মতো অভিজ্ঞ পেসারও টেলরের সামনে সঠিক লাইন খুঁজতে হিমসিম খেলেন। তবে নিষ্ঠুরতার সিংহভাগ বরাদ্দ ছিল ওঝার জন্য। তাঁর এক ওভার থেকে চারটে বাউন্ডারি এল। থার্ড ম্যান, ফাইন লেগ, কভার, এক্সট্রা কভারকোনও কিছু বাদ নেই। টেলরের ধ্বংসলীলা দেখতে দেখতে ততক্ষণে মন্ত্রমুগ্ধ কেএসসিএ সচিব জাভাগল শ্রীনাথ (যাঁর আজ আবার জন্মদিন ছিল)।

আর সেঞ্চুরি করে যখন হেলমেট খুলছেন টেলর, সৌরভ গঙ্গোপাধ্যায়ের মুখ থেকে ছিটকে বেরোল, “টেরিফিক সেঞ্চুরি। ক্যাপ্টেন কাকে বলে!’’ মূলত তাঁর জন্যই নিউজিল্যান্ড দিনের শেষে ৩২৮-৬, চোখের সামনে ঝুলছে চারশো-সওয়া চারশো রানের স্বস্তির স্কোরবোর্ড। ম্যাচও পাঁচ দিনে যাওয়ার সম্ভাবনা।
যা-ই হোক, শেষ পর্যন্ত ওঝাই (৪-৯০) নিলেন টেলরকে। সঙ্গে আরও তিন কিউয়িকে। বরাবরের লাজুক, মুখচোরা টিম ইন্ডিয়ার এই বাঁ-হাতি স্পিনার না থাকলে, ভারত অধিনায়কের অস্বস্তি আরও বাড়ত আজ। ওঝা পরে বলছিলেন, “সারা দিনে ছ’টা উইকেট পড়েছে ওদের। আমাদের পারফরম্যান্স খারাপ কোথায়?” এক দিক থেকে ঠিক। কিন্তু গত টেস্টে যাদের দু’টো ইনিংস দু’শোর কম রানে ফুরিয়েছে, তাদের এক দিনেই তিনশো পার করতে দেওয়াও কতটা যুক্তিযুক্ত? আশ্চর্য লাগতে পারে ক্যাপ্টেন কুলের স্ট্র্যাটেজি দেখলে। অশ্বিন একটা ছয় খেতেই ফিল্ড ছড়িয়ে দিলেন। কেন এই ডিফেন্সিভ ফিল্ডের ছক, কে জানে। স্পিনার পেলেই টেলর-সহ বাকিরা সুইপ মারছেন দেখেও তো ধোনির ঝুলি থেকে কোনও ‘প্ল্যান বি’ বেরোল না।
‘টার্নার’ চেয়ে বোর্ডের কাছে ভারত অধিনায়ক আবেদনপত্র জমা করছেন, ঠিক আছে। ওঝাকে দিয়ে বোলিং ওপেন করানোও তাঁর স্ট্র্যাটেজিক ‘মুভ’, সেটাও তর্কের খাতিরে মানা গেল। কিন্তু এই প্রশ্নের উত্তরগুলো তো ধোনির নিজেরও খুঁজে বার করা দরকার।

খেলাধূলা